বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন: কার লাভ, কার ক্ষতি?

বাংলাদেশ ব্যাংক: কোটা আন্দোলনের সূত্র ধরে ২৪ জুলাই যে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল, তার পেছনের কারণ কেবল একটি ইস্যু নয়—বরং অনেক গভীরে নিহিত। হঠাৎ করেই মানুষ রাস্তায় নামে নাই, ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে নাই কিংবা সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নামে নাই। এর পেছনে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ জমে ছিল।

২০০১-২০০২ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা স্মরণ করলে দেখা যায়—তখন থেকেই সরকারি ও বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অদক্ষতা এবং স্বচ্ছতার অভাব ক্রমশ বাড়ছিল। পরবর্তীতে সরকারি খাতের অতিরিক্ত তহবিল সংগ্রহের ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যায় (অর্থনীতির ভাষায় Crowding Out Effect), যা বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিকে সীমিত করে দেয়। একই সময়ে লুটপাট, চাঁদাবাজি এবং অতি মুনাফাখোরদের প্রভাব মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়, ফলে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তোলে।

এই অর্থনৈতিক চাপই জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম পটভূমি। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। উন্নয়ন প্রকল্প—যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল—বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ হলেও, অর্থনীতির মূল স্তম্ভ ব্যাংকিং খাতকে অবহেলা করা ছিল মারাত্মক ভুল। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ব্যাংক দখল, লুটপাট, নিয়োগ বাণিজ্য এবং টাকা পাচারের মাধ্যমে পুরো খাতকে পঙ্গু করে ফেলা হয়।

ফলাফল—আমানতকারীরা টাকা পাচ্ছেন না, উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না, আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাত ধীরে ধীরে সংকটে পড়েছে। এই নাজুক পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিল বিগত সরকারের দুর্নীতিপরায়ণ ও একগুঁয়ে নীতি।

সমাধান কী?
বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন দিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব সিদ্ধান্তে পেশাদারিত্ব ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক স্বার্থে অতিরিক্ত টাকা ছাপানো, ঋণনীতি শিথিল করা কিংবা পক্ষপাতমূলক তদারকি চালু থাকবে—যার ফল হবে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়া, মুদ্রা পাচার বৃদ্ধি, এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বাজার থেকে বিতাড়ন।

দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো, আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং আমানতকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা অপরিহার্য।

দুঃখজনকভাবে, জুলাই আন্দোলনের পেছনে থাকা এত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়টি সংস্কার কমিশনের আলোচনায় আসেনি। প্রশাসনও এ বিষয়ে অনাগ্রহী। বারবার আলোচিত হলেও বাস্তবায়ন হয়নি—প্রশাসনিক বাধাই এর মূল কারণ।

শেষ প্রশ্ন
কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন হলে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে—তাতে রাজনৈতিক দল বা প্রশাসনের ক্ষতি কোথায়? সুস্থ ব্যাংক ব্যবস্থা, আমানতের সুরক্ষা, উদ্যোক্তাদের মূলধন সরবরাহ—এসব কি জনগণের ক্ষতি নাকি লাভ? উত্তর আপনার হাতেই।

লেখক:
নজরুল ইসলাম
অতিরিক্ত পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

Comments (0)

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top